আবৃত্তি শেখার নিয়ম নিয়ে আজকের আলোচনা। আবৃত্তি একটি শিল্প। গান এবং নাচের জন্য যেমন চর্চা বা সাধনা করতে হয় আবৃত্তির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটি প্রয়োজন। বরঞ্চ আবৃত্তি শিল্পীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যদের তুলনায় আরও কঠিন বলা চলে।
যেমন: একজন নৃত্য শিল্পী যখন নৃত্য করে দর্শকের দৃষ্টি থাকে শিল্পীদের ড্রেসআপ, নাচ, এক্সপ্রেসন, গান ও বাদ্যযন্ত্রের উপর। ঠিক তেমন সঙ্গীত শিল্পীর ক্ষেত্রেও। কিন্তু আবৃত্তি শিল্পীর একমাত্র হাতিয়ার কন্ঠ। কন্ঠ থেমে গেলে ব্যাকআপ দেওয়ার মতো কিছুই থাকে না।
তাই আবৃত্তি শিখতে হলে গভীর মনোনিবেশ করতে হবে । আবৃত্তি শেখার ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো নজর দেওয়া খুবই জরুরি ।
১। আবৃত্তি কর্মশালায় যোগ দেওয়া। এর চাইতে ভালো পরামর্শ আর একটিও নেই। কারণ কর্মশালাগুলোতে আবৃত্তির আদ্যোপান্ত শেখানো হয়। আবৃত্তি কর্মশালায়, আবৃত্তি শেখার জন্য যা যা করা এবং শেখা দরকার সে সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলে থাকে। তাই আবৃত্তি কর্মশালায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলে অবশ্যই যোগ দেওয়া উচিত।
২। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণের উচ্চারণ ভালো করে চর্চা করা। স্কুল লেভেল থেকে শিখে আসা ভুল উচ্চারণগুলি শুধরে নেওয়া দরকার।
৩।বর্ণ চর্চার শব্দে নজর দেওয়া । প্রমিত বাংলায় শব্দের উচ্চারণ শেখা ও চর্চা করা। প্রমিত বাংলা নিয়মের কিছু বই আছে সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ম শেখা ও চর্চা করা।
৪। আঞ্চলিকতা পরিহার করা।
৫। স্বরের স্কেল শেখা। কখন স্বর উঠবে বা নামবে।
৬। কবিতার বোধ বুঝা ও বারবার কবিতাটি পড়া।
৭। মুখের কিছু ব্যায়াম আছে, সেগুলো মাঝে মাঝে করা।
৮। প্রতিদিন সকালে গরম পানি দিয়ে গারগেল করা। কন্ঠকে ভালো রাখবার জন্য।
৯। আবৃত্তির স্টেজ প্রোগ্রাম দেখা।
আবৃত্তি শিক্ষার আরো অনেক নিয়মকানুন আছে, যা আবৃত্তি চর্চার বই পড়েও জেনে নেওয়া যেতে পারে।
(YouTube এর আবৃত্তি দেখে এবং শুনে আবৃত্তি চর্চা করলে ভালো আবৃত্তি শেখা সম্ভব নয় বরং এর জন্য প্রয়োজন কোন খ্যাতিমান আবৃত্তিকারের তত্ত্বাবধানে আবৃত্তি চর্চা করা।)
কবিতা আবৃত্তির কিছু সাধারণ নিয়ম কি?
– আবৃত্তি শিক্ষার ধরা বাঁধা নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকলেও যেসব নিয়মগুলি আবৃত্তির শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মেনে চলা দরকার সেগুলি হলঃ
কবিতাটা আগে ভালো করে মুখস্থ করতে হবে- আবৃত্তি করার আগে আপনার সামনে প্রথমেই কবিতাটি তুলে দেওয়া হবে। খুব ভালো করে সেটা মুখস্থ করে নিন যাতে মঞ্চে উঠে ভয় না করে, ভয় করলে কিন্তু কবিতা বলাটা ঠিকঠাক হবে না।
স্পষ্ট উচ্চারণ- সুন্দর, স্পষ্ট উচ্চারণ হতেই হবে। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি লাইনে শেষের শব্দটা মাইকে শোনা যাচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায় যে লাইনের শেষের শব্দটি বলতে গিয়ে সেটা অস্পষ্ট হয়ে যায়, তাই মাইকে সেটা ধরতে পারেনা। বারবার এই সমস্যা হলে শুনতে ভালো লাগবে না।
শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক রাখতে হবে- শ্বাস ঠিক রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কথার মাঝখানে যেন শ্বাস থেমে না যায় সেটা বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। যদি শ্বাসের সমস্যা থাকে তাহলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসুন। শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম থাকে সেগুলো করতে পারেন।
কথা বলার গতি ঠিক রাখতে হবে- খুব তাড়াতাড়ি লাইনের পর লাইন বললে যেমন হবে না তেমন খুব বেশি ধীর গতিতে বললেও হবে না। যেভাবে বুঝিয়ে কথা বলতে হয়, সেভাবেই স্বাভাবিক গতিতে কবিতাটা পড়ুন।
গলার জোর থাকতে হবে- এখানে গলার জোর মানেই কিন্তু এই নয় যে খুব জোরে জোরে চিৎকারের মত কবিতা বলতে হবে। এখানে গলার জোর মানে firmness। যদি খুব আস্তে আস্তে কবিতা বলেন তাহলে ব্যাপারটা মিনমিনে বলে মনে হবে আবার বেশি জোরে বললে চিৎকারের মত শোনাবে। তাই সেদিকে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে একমাত্র অভ্যাস করেই সেটা আয়ত্ব করতে হবে।
কবিতার অর্থ বুঝতে হবে, সেই অনুযায়ী কবিতার সুর বুঝতে হবে- কবিতাটা বারবার পড়ে সেটা কোন অনুভুতি নিয়ে লেখা সেটা বুঝতে হবে। এবারে সুর মানে তো গানের সুর নয়, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। একটা উদাহরণ নিচ্ছি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি কবিতা নিচ্ছি- “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” আর “সাধারণ মেয়ে”। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতায় এরকম বোঝা যাচ্ছে যে একটি ঝর্না গুহার মধ্যে দিয়ে গিয়ে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সকল বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে উঠে অবশেষে সূর্যের কিরণ দেখতে পায়, গায়ে সূর্যের আলোর স্পর্শ লেগে সে শান্তি পায়।
এখানে কবিতার প্রথম দিকে বাধা কাটিয়ে ওঠার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ফুটে উঠছে, শেষে ফুটে উঠেছে শান্তি ও সন্তুষ্টি। তাই কবিতাটাও এমন ভাবে বলতে হবে যেখানে আপনার কণ্ঠে সেই শক্তি, আবেগ ও শান্তি ফুটে ওঠে। কোন জায়গায় কিরকম আবেগ নিয়ে বলতে হবে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে।
এবারে আমরা যদি দেখি সেই “সাধারণ মেয়ে” কবিতাটি, এখানে দেখা যায় কবিতা শুরু হয় এরকম করে যেখানে একটি মেয়ে শ্রী শরৎচন্দ্রের উদ্দশ্যে একটা চিঠির মাধ্যমে তার অনুভুতি, দুঃখ, কষ্ট ব্যক্ত করছে। কবিতা পড়লে বুঝবেন এই কবিতাটা অনেকটা গল্পের মত। তাই এই কবিতাটার বেশিরভাগ জায়গা স্বাভাবিকভাবে গল্পের মত করে, স্বাভাবিক সুরেই পড়তে হবে। আবার “বাঁশিওয়ালা” কবিতায় এই দুটি স্টাইলের মিশ্রন রয়েছে। কিছু জায়গা গল্পের মত, কিছু জায়গা বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ওঠার ইচ্ছাশক্তি, মুক্তির আকাঙ্খা।
গানের একটি নির্দিষ্ট সুর থাকে, তাল থাকে। কিন্তু কবিতায় শুধু নিজের কন্ঠ দিয়েই পুরো ভাব ফুটিয়ে তুলতে হয়। এখানেই আবৃত্তির মজা। সব শেষে বলি, আবৃত্তিকে এভাবে নিয়মে বেঁধে না রেখে অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ব করলেই ভালো। সেজন্য ভালো ভালো শিল্পীর আবৃত্তি শুনতে পারেন। আমি আমার খুব প্রিয় দুই শিল্পী শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্রদ্ধেয়া ব্রততি বন্ধোপাধ্যায়ের আবৃত্তির দুটি ইউটিউব লিঙ্ক জুড়ে দিচ্ছি।