কান্ডারী হুশিয়ার কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত দেশাত্মবোধক কবিতা, যা ১৯২৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি তাঁর “সঞ্চিতা” কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এবং ব্রিটিশবিরোধী যুগে বাঙালির জাতীয় চেতনার জাগরণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।
কবিতাটি একটি জাহাজ-সাদৃশ্য রূপকে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করে। দেশের অধঃপতন, দুর্নীতি, বিভাজন ও সংকটে কবি বিপদের সংকেত দিয়ে অধিনায়ককে সতর্ক করছেন—”কান্ডারী হুশিয়ার!”। এটি কেবল রাজনৈতিক নেতা নয়, গোটা জাতির প্রতি একটি দৃঢ় আহ্বান—জাগো, সচেতন হও, দায়িত্ব নাও।
নজরুলের এই কবিতার ভাষা দৃঢ়, আবেগময় এবং উত্তাল। কবিতাটি আবৃত্তির জন্যও অত্যন্ত জনপ্রিয়, কারণ এতে কণ্ঠের উচ্চারণে উঠে আসে সাহস, বিদ্রোহ ও আহ্বানের স্পষ্ট ধ্বনি। এই কবিতায় বাঙালির জাগরণের ডাক আছে, আছে আত্মবিশ্বাস ও পরিবর্তনের প্রত্যয়।
“কান্ডারী হুশিয়ার” তাই শুধু একটি কবিতা নয়—এটি একটি ইতিহাস, এক জাতীয় চেতনার স্ফুলিঙ্গ, যা আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ক।
কান্ডারী হুশিয়ার
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!
